খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর ভা'রতবর্ষে আগমন ও ইস'লাম প্রচার

খাজা গরিবে নেওয়াজ মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী ছিলেন মুবাল্লিগ, মুফাক্কির, উদার, সহানুভূতিসম্পন্ন, বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ও গভীর মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব।

হযরত মুঈনুদ্দীন হাসান ৫৩৬ হিজ’রিতে ই’মাম গাযযালীর মৃ’ত্যুর ৩১ বছর পর, পারস্যের সিজিস্তান নামক প্রদেশের সানজা নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

তার পিতা খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান ছিলেন একজন ধনবান ও প্রভাবশালী বণিক। মাতার নাম ছিল মাহে নূর। তার দ্বাদশতম পুরুষের মাধ্যমে পিতামাতা উভ’য়দিক হতে আলী রা. সাথে স’ম্পর্কিত।

ফলে তিনি পিতা ও মাতা উভ’য় দিক দিয়েই ছিলেন সাইয়্যিদ। (এম’দাদিয়া লাইব্রেরি, তায্কেরাতুল আওলিয়া,খণ্ড-৪,পৃষ্ঠা-২৭১)

খাজা সাহেবের পনেরো বছর বয়সে পিতা মৃ’ত্যুবরণ করেন এবং অল্প কিছু দিন পরে তার মাতাও ই’ন্তেকাল করেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ফলের বাগান ও একটি চাক্কি (উইন্ডমিল) লাভ করেন; যার আয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।

তার মনে ইস’লামের প্রতি গভীর আকর্ষণ জন্ম নেয়। তিনি যাবতীয় সম্পত্তি দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সংসারের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন এবং উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বুখারায় পাড়ি জমান।

গরিবদের প্রতি তার অসীম মমতা ছিল, সবসময় তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন তিনি। এ কারণেই তাকে ‘গরিবে নেওয়াজ’ বলে ডা’কা হয়।(গরিবে নেওয়াজ, সুলতানে হিন্দ, রোর বাংলা)

খাজা মুঈনুদ্দীন ইলমের সন্ধানে গৃহ’ত্যাগ করেন এবং বোখারা, সম’রকন্দ সফর করেন। তিনি প্রথমে কুরআন হিফজ করেন। অ’তঃপর তাফসির, হাদিস, ফিকাহ ও অন্যান্য শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন।

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আধ্যাতিক জ্ঞানার্জনে ও মুর্শিদের অন্বেষণে বোখারা থেকে ই’রাকের দিকে সফর শুরু করেন। পথিমধ্যে নিশাপুরে হারুন নামক স্থানে চিশতিয়া তরিকার বিখ্যাত বুজুর্গ উসমান হারুনীর সাথে সাক্ষাৎ হয়।

তিনি চিশতিয়া তরিকায় খাজা উসমান হারুনীর নিকট মুরিদ হন ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত থাকেন। পরে উসমান হারুনী তাকে খিলাফত বা সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন। (আরবি উইকিপিডিয়া, খাজা মুঈনুদ্দীন সিজযী)

উসমান হারুনীর থেকে বিদায় নিয়ে তিনি হ’জব্রত পালনের জন্য দামেস্ক ও হেযায হয়ে ম’ক্কা মুয়াজ্জমায় পৌঁছেন, অ’তঃপর ম’দিনা মুনাওয়ারা গিয়ে রাসূলের রওজা জিয়ারত করেন।

এরপর তিনি বাগদাদ অ’ভিমুখে যাত্রা করেন এবং পথিমধ্যে অনেক ওলামা-মাশায়েখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; যাদের মধ্যে নাজিমুদ্দিন কোবরা উল্লেখযোগ্য।

এ সময় বাগদাদের খলিফা ছিলেন আলমু’স্তানজিদ বিল্লাহ। অনেকের মতে মুঈনুদ্দীন চিশতী শায়খ আব্দুল কাদের জিলানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ৫৭ দিন তার সান্নিধ্যে অ’তিবাহিত করেন।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী বাগদাদ থেকে আবার সফর শুরু করেন এবং তাবরিয, ইস্পাহান, আস্তারাবাদ, সাবযাওয়ার, মিহনা, বলখ এবং গযনী হয়ে হিন্দুস্তানের লাহোরে আগমন করেন।

লাহোরে শায়খ আলী হুযবিনীর মাজারে কিছুকাল মুরাকাবায় অ’তিবাহিত করে দিল্লি চলে আসেন।

সে সময় ভা’রতবর্ষের আজমির ছিল হিন্দু ধ’র্ম ও আধ্যাত্মিকতা এবং সাম্রাজ্য ও রাজপুত শক্তির মূল কেন্দ্রস্থল। ১০ মুহররম ৫৬১ হিজ’রিতে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরে চল্লিশজন দরবেশসহ দিল্লি থেকে আজমীরে পৌঁছান।

এ সময় আজমীরের শাসনক’র্তা ছিলেন পৃথ্বিরাজ বা রায় পথুরা। ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ ঘুরি প্রথম পর্যায়ে তার অ’ভিযান উত্তর-পশ্চিম ভা’রতবর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন।

কিন্তু রাজা পৃথ্বিরাজ তার দরবারের জনৈক সভাসদ যিনি খাজা সাহেবের মুরিদ ছিলেন ক’ষ্ট ও বিপদের মধ্যে ফেলেন। এরপর প্রতিকার চেয়ে খাজা সাহেব পৃথ্বিরাজকে পত্র লেখেন।

পৃথ্বিরাজ অবমাননাকর ভাষায় পত্রের জবাবে বলেন, ‘এই লোকটি এখানে আসার পর এমন বড় বড় কথা বলেন যা কেউ কখনো বলেনি আর শোনেওনি।’

হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী জবাবে বলেন, ‘আমি পৃথ্বিরাজকে জীবিত ব’ন্দি করে মুহাম্মাদ ঘুরির হাতে তুলে দিলাম।’

এরপরই মুহাম্মাদ ঘুরি আজমীর আক্রমণ করেন এবং পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করেন। (গো’লাম আলী আজাদ, মাআছিরুল কিরাম,পৃষ্ঠা-৭)

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী কর্তৃক আজমীরকে দাওয়াত,তাবলিগ ও তাজকিয়ার জন্য মনোনীত করা ছিল এক আধ্যাত্মিক বিজয়। তার এই অটুট সংকল্প, উচ্চ মনোবল ও ই’মানি সাহসিকতার বদৌলতে সত্যিকার ধ’র্মবিশ্বা’স হতে বঞ্চিত ভূখণ্ডে তাওহীদের আলো ছড়িয়ে পড়ে।

তার তাকওয়া, লিল্লাহিয়াত, খোদাভীরুতা ও ঐকান্তিক ত্যাগ স্বীকারের ফলে কুফর ও শিরকের রাজত্ব ইস’লামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ওলামায়ে কেরামের আবাসভূমিতে পরিণত হয়।(সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী, তারীখে দাওয়াত ওয়া আজিমত, খণ্ড-৪)

একমাত্র খাজা মুঈনুদ্দীনের প্রচেষ্টা ও প্রভাবে যেখানে শিরকের কালো অন্ধকার বিরাজ করত সেখানে ম’সজিদ, মিম্বার দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। যে আসমান পৌত্তলিকতা ও শিরকের বিষবাষ্পে ছিল ভরপুর সেখানে আল্লাহু আকবার ধ্বনিত হতে থাকে।

ভা’রতবর্ষে কিয়ামত পর্যন্ত মু’সলমানের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে এবং ইস’লামের প্রচার ও প্রসারের সীমা যতই বিস্তৃত হতে থাকবে, তার সওয়াব শায়খুল ইস’লাম খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতীর রূহে ততই পৌঁছতে থাকবে।(সিয়ারুল আওলিয়া,পৃষ্ঠা-৪৭)

এ ব্যাপারে কোনো স’ন্দেহ নেই যে, চিশতিয়া সিলসিলার মহান বুজুর্গ ও মনীষীগণের ভা’রতীয় উপমহাদেশের ওপর চিরন্তন দাবি ও অধিকার রয়েছে। (গো’লাম আলী আযাদ, মাআছিরুল কিরাম,পৃষ্ঠা-৭)।

হযরত খাজার জীবদ্দশায় ভা’রতবর্ষের রাজনৈতিক কেন্দ্র আজমীর হতে দিল্লিতে স্থা’নান্তরিত হয় এবং আজমীর তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ারকে দিল্লিতে অধিষ্ঠিত করেন।

অন্যদিকে তারই একান্ত ভক্ত-অনুর’ক্ত খাদেম সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ দিল্লির মসনদে সমাসীন হয়ে সাম্রাজ্যের প্রসার, ভিত্তি সুদৃঢ়করণ, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকেন।

আর খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরেই বাকি জীবন ইস’লাম প্রচার-প্রসার, তালিম-তরবিয়াত ও তাজকিয়ার কাজে অ’তিবাহিত করেন (ইস’লামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ইস’লামী বিশ্বকোষ,দশম খণ্ড,পৃষ্ঠা-৭২৭)।

৯০ বছর বয়সে ৬২৭ হিজ’রিতে তিনি এমন মুহূর্তে ইহ’জগৎ ত্যাগ করেন, যখন ভা’রতবর্ষের মাটিতে তারই নিজ হাতে লাগানো চারা ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে।

লেখক: শিক্ষক,গবেষক

Back to top button
error: Alert: Content is protected !!